views
বাংলা সাহিত্যের অমর প্রতিভা কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতকার, নাট্যকার এবং সমাজচিন্তক। তিনি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি শুধু সাহিত্যকেই নয়, বরং বাংলা সমাজ ও রাজনীতিকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁর লেখনীতে স্পষ্ট ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধাচরণ, ধর্মীয় কুসংস্কারের সমালোচনা, এবং সমাজ পরিবর্তনের আহ্বান। তাঁর কবিতার মধ্যে ছিল বিদ্রোহ, চেতনাজাগরণ এবং এক অদম্য স্পর্ধা। এসব কারণেই তাঁকে বলা হয় ‘বিদ্রোহী কবি’। কিন্তু এই উপাধিটি কেবল কথার কথা নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক মূল্যবোধ বহন করে। পাঠক মহলে দীর্ঘদিন ধরেই একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়: কাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি উপাধি দেন কে?
নজরুলের বিদ্রোহী মনোভাবের উত্থান
‘বিদ্রোহী’ কবিতার তাৎপর্য
১৯২২ সালে প্রকাশিত নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ তাঁকে রাতারাতি ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। এই কবিতায় তিনি বলেন,
"আমি চির-বিদ্রোহী বীর – বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!"
এই একটি পঙক্তিতেই স্পষ্ট যে নজরুল নিজেই নিজেকে বিদ্রোহী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এটি কেবল একটি আত্মপ্রকাশ নয়, বরং সামন্ততন্ত্র, ঔপনিবেশিক শাসন এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর এক দুরন্ত ঘোষণাপত্র।
সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিদ্রোহ
নজরুলের সময়কাল ছিল এমন এক সময়, যখন ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসছিল। অন্যদিকে সমাজে ধর্মীয় কুসংস্কার, নারী নিপীড়ন ও বর্ণবৈষম্য বিদ্যমান ছিল। এসব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে নজরুল তাঁর লেখনীকে ব্যবহার করেছিলেন অস্ত্র হিসেবে। এই অসাধারণ সাহসী ভূমিকার কারণে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের কাছে।
‘বিদ্রোহী কবি’ উপাধির সূচনা
সাহিত্যমঞ্চ ও পত্রিকায় প্রতিধ্বনি
নজরুলের কবিতা যখন সাহিত্যপত্রিকা ও মঞ্চে উচ্চারিত হতে শুরু করল, তখন তাঁর কবিতার ধরণ দেখে পাঠক ও সাহিত্যিক মহলে বিস্ময় জেগে ওঠে। তিনি তখনকার সাহিত্যে প্রচলিত নরম অনুভূতির বিপরীতে দাঁড় করান এক দুর্বিনীত, সাহসী এবং ক্ষোভপ্রকাশক ধারা। এই পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন ছিল নতুন এক অভিধা, যা তাঁর পরিচয়কে ধারণ করবে। তখন থেকেই সাহিত্যমহলে কেউ কেউ তাঁকে ‘বিদ্রোহী কবি’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করেন।
সংবাদপত্র ও সমসাময়িক লেখকদের অবদান
নজরুলের সময়কার কিছু সংবাদপত্র এবং সাহিত্যিক পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে মন্তব্য পাওয়া যায়। কিন্তু ইতিহাসবিদদের বিশ্লেষণে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য একটি নাম হল ধূমকেতু পত্রিকা। এই পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও অন্যান্য লেখার ভিত্তিতে তাঁকে বিদ্রোহী কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
তবে অনেক ঐতিহাসিক এবং গবেষক একমত যে, মূলত সাহিত্যসমালোচক ও লেখক মোহিতলাল মজুমদার-ই প্রথম প্রকাশ্যে নজরুলকে “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি সাহিত্য-সমালোচনায় বলেছিলেন যে নজরুল বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহের নতুন ধারা সূচনা করেছেন, এবং তার মধ্য দিয়ে নজরুল হয়ে উঠেছেন অনন্য।
এই কারণেই ইতিহাসের বিচারে প্রশ্নটি – কাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি উপাধি দেন কে – এর উত্তর মূলত মোহিতলাল মজুমদার-এর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
বিদ্রোহী কবি উপাধির প্রভাব
নজরুলের পরবর্তী সাহিত্যযাত্রা
‘বিদ্রোহী কবি’ উপাধি পাওয়ার পর নজরুল তাঁর লেখনীতে আরও বেশি স্বাধীনচেতা হয়ে ওঠেন। তিনি রচনা করেন ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদী’, ‘দুর্দিনের যাত্রী’-র মতো চেতনামূলক কবিতা। তাঁর প্রতিটি লেখা যেন হয়ে ওঠে শোষিতের কণ্ঠস্বর।
সমাজে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
নজরুলের বিদ্রোহ শুধু সাহিত্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সমাজে এক ধরনের জাগরণ সৃষ্টি হয় তাঁর কারণে। তাঁর গান, কবিতা, প্রবন্ধের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাই প্রকৃত সাহসিকতা।
এছাড়াও নজরুল ইসলাম বাংলা সংগীতেও এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। ইসলামী সংগীত, শ্যামা সংগীত, প্রেমের গান—সব ক্ষেত্রেই তাঁর বিদ্রোহী স্বভাব প্রতিফলিত হয়। তাঁর সৃষ্টিতে প্রেম ও বিপ্লব যেন এক হয়ে গিয়েছে।
নজরুলকে নিয়ে মূল্যায়ন
সরকারি ও জাতীয় স্বীকৃতি
বাংলাদেশ সরকার নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারতের বিভিন্ন সাহিত্যসভা এবং প্রতিষ্ঠানও তাঁকে সম্মানিত করেছে। তাঁর কবিতা পাঠ করে আজও অনুপ্রাণিত হয় নতুন প্রজন্মের লেখকরা।
বিদ্রোহী চেতনার প্রতীক
নজরুল কেবল একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি আন্দোলনের নাম। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যেভাবে কলম ধরেছিলেন, তাতে স্পষ্ট হয়ে যায় তাঁর অন্তর্নিহিত মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এই কারণেই ‘বিদ্রোহী কবি’ উপাধি শুধু একটি নাম নয়, বরং একটি দর্শনের প্রতিফলন।
উপসংহার
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য উচ্চতা। তাঁর কলমে ছিল বিদ্রোহের আগুন, প্রেমের কোমলতা এবং মানুষের মুক্তির গান। তিনি যে শুধু একজন কবি ছিলেন তা নয়, তিনি হয়ে উঠেছিলেন মানুষের অন্তরের ভাষ্যকার। আজও তিনি প্রাসঙ্গিক, আজও তাঁর কবিতা আমাদের সাহস জোগায়। এবং সেই সাহসিকতার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে যে “বিদ্রোহী কবি” বলা হয়, সেটির পেছনে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তথ্য অনুযায়ী, কাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি উপাধি দেন কে—এই প্রশ্নের উত্তর হলো, সাহিত্যসমালোচক মোহিতলাল মজুমদার। তাঁর দেয়া এই উপাধিই নজরুলকে চিরকালীন পরিচয় এনে দিয়েছে, যা যুগ যুগ ধরে পাঠক হৃদয়ে সমাদৃত থাকবে।

Comments
0 comment